Reading Time: 3 minutes
জুলমাত খোন্দকার ঘুম থেকে উঠে হকচকিয়ে গেলেন। ঘরে এই সময় কেউ থাকার কথা না। খুব মনে আছে দরজা-জানালা সব বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলেন। অথচ দেখলেন বিছানার কোণে একজন বসে আছে। মুখ দেখা যায় না, কালো একটা আলখেল্লা পড়া।
জুলমাত খোন্দকার চিৎকার করে উঠতে চাইলেন, কিন্তু মনে হল কেউ একজন গলা চেপে ধরে আছে। ফলে নিজের ফ্যাসফ্যাস গলাই অজানা মনে হলো নিজের কাছে। ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলেন-ক্কে ক্কে আপনি?
লোকটি সেভাবেই বসে থেকে কেবল মুখটা জুলমাত খোন্দকারের দিকে ঘুরিয়ে আনলেন। মুখটা ভয়াবহ সাদা, কেবল চোখ দুটোই কালো। মোটেই স্বস্তি দেয় না এই মুখ। অমঙ্গলের পরিস্কার ঈঙ্গিত সেখানে।
জুলমাত খোন্দকার আবারও প্রশ্ন করলেন-কে আপনি?
লোকটি নির্মোহ ভঙ্গিতে কেবল বললেন-আমি মৃত্যু।
জুলমাত খোন্দকারের চোয়াল ঝুলে পড়ল। তার বয়স এখন ৩৫, বিয়ে করেননি। আয়শা নামের একটি মেয়ের সঙ্গে বিয়ের কথাবার্তা চলছে। মাঝে মধ্যে ফোনে কথাও হয়। জুলমাত খোন্দকারের ঠিক এ সময়ে আয়শার কথা মনে পড়ল।
ভয় পেলে কথা একটু জড়িয়ে যায়, তোতলানোর ভাব আসে। জুলমাত খোন্দকার ভীষণ ভয় পেয়ে জানতে চাইলেন-আ আ আ আপনি এখানে কেন?
মৃত্যু নামের লোকটা সেই একই ভঙ্গিতে বললেন-আপনাকে নিতে এসেছি। আপনার সময় হয়ে গেছে।
জুলমাত খোন্দকার অসহায়ের মতো খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন মৃত্যুর দিকে। তারপর এইটুকুই কেবল বলতে পারলেন-এতো তাড়াতাড়ি?
মৃত্যুর চোখে একটু কী করুনা দেখা গেল? জুলমাত খোন্দকারের অন্তত তাই মনে হল।
মৃত্যু বলল-তালিকা আমি তৈরি করি না। এই দেখেন আমার হাতে লম্বা তালিকা। হাতে সময় নেই। আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে।
জুলমাত খোন্দকার সত্যি তাকিয়ে দেখলেন, মৃত্যুর হাতে লম্বা একটা কাগজ। সেখানে অনেক নাম।
মৃত্যু তার সঙ্গে কথা বলছে দেখে খানিকটা সাহস ফিরে পেল জুলমাত খোন্দকার। ভাবল কিছুক্ষণ ঠেকিয়ে রাখা যায় কীনা। মনে পড়ল অনেক আগে দি সেভেন্থ সিল নামে একটা সুইডেনের তৈরি সিনেমা দেখেছিলেন। সেখানে সিনেমার নায়ক মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখতে মৃত্যুর সঙ্গেই দাবা খেলা শুরু করেছিল।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে জুলমাত খোন্দকার নিজে ভাল দাবা খেলতে পারেন না। সুতরাং দাবা খেলে ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। অন্য পথ ধরতে হবে। সাহস করে কথাটা বলেই ফেললেন।
বললেন-এসেছেন যখন, একটু সময় দেন। গ্রামে মা-বাবা থাকেন। আমি মারা গেলে তারা আমার জমানো টাকা কীভাবে পাবেন সেটা একটু ঠিকঠাক করে রাখি। আরও ছোটখাট কিছু কাজ আছে। আর তো এই পৃথিবীতে আসতে পারব না। এইটুকু সময় অন্তত আমাকে দেন। সে আয়শার কথা আর বলল না। কী লাভ মৃত্যুকে আয়শার পথ চিনিয়ে দেওয়া।
মৃত্যুর মনেহয় খানিকটা দয়া হল। বলল-বেশি না কিন্তু। আমাকে আবার আরেক জায়গায় যেতে হবে।
জুলমাত খোন্দকার ভাবলেন, সময়টা কাজে লাগাতে হবে। রান্না ঘরে গেলেন তিনি। যত্ন করে দুটো স্যান্ডুয়েচ বানালেন। তারপর আলাদা আলাদা প্লেটে নিয়ে বসলেন আবার বিছানায়। একটা বাড়িয়ে দিলেন মৃত্যুর দিকে। অবাক হয়ে দেখলো মৃত্যুরও তাহলে ক্ষুধা লাগে। স্যান্ডুয়েচটা খেতে শুরু করলেন।
এবার জুলমাত খোন্দকার যত্ন করে দুকাপ কফি বানালেন। ব্রাজিল থেকে তার এক বন্ধু কফিটা এনে দিয়েছিল। ঢাকা থেকে কিনে রেখেছে কফি ক্রিম। জুলমাতের অলস সময়ের সবচেয়ে বড় বিলাসিতা হচ্ছে আয়েশ করে মগ ভর্তি কফি খাওয়া।
কাপ ভর্তি কফিটা এবার তিনি রাখলেন মৃত্যুর সামনে। মৃত্যু সেটিও নিলেন। জুলমাত খোন্দকার এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন সেদিকে। কষ্ট আর কৌশলটা বৃথা যায়নি। পাঁচ মিনিটের মধ্যে এলিয়ে পড়লেন বিছানায়। গভীর ঘুমে মৃত্যু। ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলেন জুলমাত খোন্দকার।
ঘুমিয়ে গেলেও জুলমাত খোন্দকার জানেন যে পালিয়ে বা লুকিয়ে থেকে লাভ হবে না। মৃত্যু ঠিকই তাকে খুঁজে বের করবে। অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে। মৃত্যুর পকেট থেকে তিনি তালিকাটা বের করলেন। দেখলেন সত্যিই তার নামটি সবার আগে। জুলমাত খোন্দকার ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে প্রথম নামটা মুছে ফেললেন। তারপর সেই নামটা নিজ হাতে লিখে দিলেন সবার শেষে। তারপর অপেক্ষায় থাকলেন মৃত্যুর, ঘুম থেকে জেগে ওঠার জন্য।
টানা ৬ ঘন্টা ঘুমালেন মৃত্যু। উঠেই আবার হাই তুললেন। তারপর তাকালো জুলমাত খোন্দকারের দিকে। একটু হাসিও দেখা গেল তার মুখে। জুলমাতকে বললেন-অনেক ঘুম পেয়েছিল। সারা রাত কাজ করেছি তো তাই। কফিটাও ছিল মজার। আপনি অনেক যত্ন করেছেন। অন্য সবাই ভয় পেয়ে উল্টা পালটা কান্ডকারখানা করে। কিন্তু আপনি করেননি। আপনার ওপর আমি খুশী। তাই আমি সিদ্ধান্ত বদল করেছি। কেবল আপনার জন্যই এই সিদ্ধান্ত বদল।
তারপর মৃত্যু জানালেন সেই সিদ্ধান্ত। বললেন- কেবল আপনার জন্যই পুরোটা অদল বদল করলাম। আপনার নাম ছিল শুরুতে। তাই পালটে দিলাম। এই মুহূর্ত থেকে তালিকার একদম শেষ নামটা দিয়ে কাজ শুরু করব…
আবার চোয়াল ঝুলে পড়ল জুলমাত খোন্দকারের।