নিউইয়র্ক থেকে রানা প্লাজা


Reading Time: 4 minutes

নিউইয়র্কের ট্রায়াঙ্গাল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে মূলত মেয়েদের কাপড় তৈরি করা হতো। তৈরি পোশাকের এই কারখানা ছিল ওয়াশিংটন স্কয়ার পার্কের পাশে অ্যাশ বিল্ডিংয়ের অষ্টম, নবম ও দশম তলায়। কারখানায় কাজ করতেন ৫০০ শ্রমিক। তাঁদের বড় অংশই ছিলেন অভিবাসী নারী, তাঁরা সপ্তাহে আয় করতেন সাত থেকে ১২ ডলার। এটি ছিল ব্লাউজ তৈরির সে সময়ের সর্ববৃহৎ পোশাক কারখানা।
১৯১১ সালের ২৫ মার্চ এই কারখানায় আগুন লাগে। বিকেল চারটা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন লাগার পর চারটা ৪৫ মিনিটে প্রথম অ্যালার্ম বাজানো হয়েছিল। তবে শ্রমিকেরা বের হতে পারেননি। কারণ, সিঁড়িতে যাওয়ার সব কটি দরজায় কারখানার ম্যানেজার তালা লাগিয়ে রেখেছিলেন। এ ঘটনায় ১৪৬ জন শ্রমিক মারা যান। সবচেয়ে কম বয়সের যে মেয়েটি মারা যায়, তার বয়স ছিল ১৪ বছর।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া যায়। কারখানার দুই মালিক মাক্স ব্ল্যাঙ্ক ও আইজাক হ্যারিস, দুজনই আগুন লাগার সময় কারখানায় ছিলেন এবং কারখানা থেকে বের হয়ে যান। ১০ তলা এই ভবন থেকে কেউ কেউ লাফ দিয়ে বাঁচারও চেষ্টা করেছিলেন। সবচেয়ে হূদয়বিদারক দৃশ্যটির কথা এখনো উল্লেখ করা হয়। নিচে অসংখ্য মানুষ দেখেছে, লাফ দেওয়ার ঠিক আগে একজন পুরুষ শ্রমিক একজন নারী শ্রমিককে চুম্বন করছেন। এই ভবন এখন ব্রাউন বিল্ডিং নামে পরিচিত এবং একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রেরই ম্যাসাচুসেটসে পেমবারটন মিল ধসে পড়েছিল ১৮৬০ সালের ১০ জানুয়ারি। এতে ১৪৫ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল। বলা নেই কওয়া নেই, হঠাৎ ভবনটি ধসে পড়ল কেন? দোষটি ছিল এর মালিকের। তাঁরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় ভারী ভারী যন্ত্রপাতি বসিয়েছিলেন। তদন্তে দেখা গেছে, ক্ষমতার অতিরিক্ত যন্ত্রপাতি বসানো ছাড়াও অত্যন্ত নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয়েছিল।
আবার ট্রায়াঙ্গাল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরির কথা। এই ঘটনায় ১৪৬ জন মারা গেলেও ছয়জনকে চিহ্নিত করা যায়নি। এতটাই পোড়া ছিল যে, কেউই চিনতে পারেননি তাঁদের। এ ঘটনার ১০০ বছর পর ২০১১ সালে ওই ছয়জনের পরিচয় উদ্ধার করা হয়। গত ১০০ বছরে এ ঘটনা নিয়ে একাধিক সিনেমা হয়েছে, মঞ্চনাটক করা হয়েছে, অসংখ্য গান রচিত হয়েছে। মালিকদের অবহেলায় ১৪৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু সে সময়ে মার্কিন রাজনীতিতেও ঝড় তুলেছিল।
আগুন লাগার এই ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের আইনকানুন পুরোটাই বদলে দিয়েছিল। দুই মালিকের বিরুদ্ধে মানবহত্যার অভিযোগ এনে বিচার হয়। তবে সবচেয়ে বড় যে কাজটি হয়, তা হলো সমাজকর্মী ফ্রান্সিস পারকিনসের নেতৃত্বে একটি জননিরাপত্তা কমিটি গঠন। সেই কমিটির সুপারিশ মেনে শ্রমিকদের অনুকূলে এবং নিরাপত্তা বাড়াতে অনেক আইন হয়। কারখানা পরিদর্শনের জন্য একটি কমিশনও গঠন করা হয়েছিল। এই কমিশন সব কারখানা পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিলে তারই ভিত্তিতে কারখানাগুলোকে আধুনিকায়ন করা হয়। বাড়ানো হয় কারখানার নিরাপত্তামান। শ্রম আইনেরও সংশোধন হয় সে সময়েই। এই আগুন লাগার ঘটনা নিয়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় লাইনটি হলো, ‘দ্য ট্রায়াঙ্গাল শার্টওয়েস্ট ফায়ার: দ্য ফায়ার দ্যাট চেঞ্জ আমেরিকা’।
আরও একটি দিক থেকে এই ঘটনা মার্কিন রাজনীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছিল। ডেমোক্র্যাটরা সেই প্রথম শ্রমিকদের পক্ষে দাঁড়ায় এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ আন্দোলনে বেশ ভালোভাবেই সম্পৃক্ত হয়েছিল। তখন থেকেই শ্রমিকেরা ডেমোক্র্যাটদের বড় ভোটব্যাংক। এখনো বলা হয়, ডেমোক্র্যাটরা শ্রমিকবান্ধব, আর রিপাবলিকানরা ব্যবসায়ীবান্ধব।
এর ১০১ বছর পর ঢাকার রানা প্লাজা ধসে মারা গেলেন এক হাজার ১৩১ জন শ্রমিক। এখনো নিখোঁজ অনেকে। অনেকের পরিচয় এখনো উদ্ধার করা যায়নি। এই ঘটনায় নিউইয়র্কের ট্রায়াঙ্গাল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরির কথা আবার নতুন করে আলোচনা হচ্ছে। রানা প্লাজা ধসের পরও শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাতে শ্রমিকের স্বার্থরক্ষা হয়েছে, তা কেউ বলছেন না। বরং বলা যায়, মালিকদের স্বার্থরক্ষাই বেশি হচ্ছে। এখন তৃতীয়বারের মতো আইনটি সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবার কারখানা পরিদর্শনের কথা বলা হলেও এর ফলাফল দৃশ্যমান নয়। তবে সবচেয়ে বড় নেতিবাচক ঘটনাটি হলো, এর ঠিক পরপরই বাংলাদেশ সেই যুক্তরাষ্ট্র থেকেই অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্যসুবিধা বা জিএসপি হারাল। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায়। আর জিএসপি বাতিলের জন্য আবেদন করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শ্রমিক ইউনিয়ন সংস্থা এএফএল-সিআইও। প্রতিষ্ঠানটি ডেমোক্র্যাটদের সমর্থক। সেই ১৯১১ সাল থেকেই শ্রমিকেরা ডেমোক্র্যাটদের বড় ভোটব্যাংক।
আরও একটা মজার ব্যাপার আছে। যুক্তরাষ্ট্র তৈরি পোশাক খাতে কোনো ধরনের সুবিধা দেয় না। অথচ জিএসপি সুবিধা বাতিল হলো তৈরি পোশাক খাতের কারণেই। অনেক দিন ধরে পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা চেয়ে আসছে। এ জন্য বহু অর্থ খরচ করে লবিস্টও নিয়োগ করা হয়েছিল। সবাই জানতেন, ২০০৫ সাল থেকে কোটাব্যবস্থা আর থাকছেই না। তার পরও শুল্কমুক্তের পাশাপাশি কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের দাবি ছিল বিজিএমইএর। দীর্ঘ এক দশকের সেই চেষ্টার সর্বশেষ ফল হচ্ছে জিএসপি সুবিধা হারানো। গত নভেম্বরে প্রথমে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং পরে এ বছরের এপ্রিলে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় জিএসপি বাঁচানোর কোনো উপায় অবশ্য আর ছিল না।
তবে মজার কাণ্ডটি করেছে বিএনপি ও খালেদা জিয়া। জিএসপি বাতিলের সুপারিশ করে খালেদা জিয়ার লেখা একটি নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল মার্কিন পত্রিকা ওয়াশিংটন টাইমস-এ। কিন্তু সত্যি সত্যি জিএসপি স্থগিত হওয়ায় এখন রাজনৈতিকভাবে বিপাকে পড়েছে দলটি। ১৯১১ সালে ট্রায়াঙ্গাল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার পর শ্রমিকদের পক্ষে নেমে ঘটনাটি পুরোপুরি নিজের অনুকূলে নিয়ে এসেছিল ডেমোক্র্যাটরা। অথচ বিএনপি অবস্থান নিল শ্রমিকদের বিপক্ষে। কারণ, জিএসপি স্থগিত হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে ক্ষতি শ্রমিকদেরই। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো ঠিকমতো রাজনীতি করাও শিখল না।
হাস্যকর কাজ করার ক্ষেত্রে সরকারি দলও পিছিয়ে নেই। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা বক্তৃতা দিচ্ছেন, খালেদা জিয়ার ওই লেখার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি সুবিধা স্থগিত করেছে। এ ধরনের রাজনৈতিক কথাবার্তায় রাজনীতির মাঠ গরম হয় ঠিকই, কিন্তু জিএসপি ফিরে পাওয়ার ব্যাপারে কোনো কিছুই হয় না। বাংলাদেশ অদ্ভুত এক দেশ। এখানে সরকারি দল আওয়ামী লীগ, অথচ শেয়ারবাজারে নজিরবিহীন কেলেঙ্কারি হয় বিএনপির নেতা-সমর্থক-বন্ধুদের কারণে। আর জিএসপি বাতিল হয় বিরোধীদলীয় নেত্রীর লেখায়। ফালু-বাদল আর খালেদা জিয়ার কারণেই যদি এত বড় সর্বনাশ হয়, তাহলে সরকার আছে কেন? সাধারণ মানুষকে এখনো বোকা ভাবেন উভয় দলের নেতা-নেত্রীরা।
ট্রায়াঙ্গাল শার্টওয়েস্ট ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগার ঘটনায় মার্কিনরা নিজেদের উদ্যোগেই তৈরি পোশাকশিল্পের পুরো কর্মপরিবেশ পাল্টে দিয়েছিল। অথচ আমরা যা করছি, তা সবই বাইরের চাপে। যদি জিএসপি বাতিলের চাপ না থাকত, যদি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হুমকি না দিত, তাহলে শ্রম আইন সংশোধন, মজুরি বোর্ড গঠন—এসব কিছুই হতো না। তাজরীনের ঘটনার সময় জিএসপি বাতিলের হুমকি নাকের ডগায় ছিল না। ফলে তাজরীনের মালিক দেলোয়ার হোসেন এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছেন। রানা প্লাজা ও কারখানার মালিকদের ভাগ্য খারাপ, বাইরের চাপটা বেশি হওয়ায় সরকারের আর উপায় ছিল না। ইতিহাস বলে, বাংলাদেশ সব সময় অর্থনীতিতে বা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করেছে দাতাদের দেওয়া সাহায্যের শর্ত পূরণের অংশ হিসেবে। একসময় বাংলাদেশ ছিল সাহায্যনির্ভর একটি দেশ। এখন বাংলাদেশ বাণিজ্যনির্ভর দেশে পরিণত হচ্ছে। অথচ স্বভাব সেই আগের মতোই।
জিএসপি বাতিলের দিন নিউইয়র্ক টাইমস তার সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করে বলেছিল, ‘শেখ হাসিনার মতো নেতারা খুব চাপে না পড়লে এমন কোনো পরিকল্পনা নিতে চান না, যাতে কারখানার মালিক ও তাঁদের পরিবার ক্ষুব্ধ হয়। বাংলাদেশের লাখ লাখ শ্রমিকের জীবন যখন বিপন্ন, তখন বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ তৈরির জন্য আমেরিকান ও ইউরোপীয় নেতাদের হাতে যে দু-একটি ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা আছে, সেগুলোকে লাগাতে হবে।’ অর্থাৎ সবাই এখন জানে, বাংলাদেশকে দিয়ে কীভাবে কাজ করাতে হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের নতুন জিএসপি আসছে ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে। মার্কিন জিএসপি কবে ফিরে পাওয়া যাবে, কেউ জানে না। সুতরাং চাপটা আরও কিছুদিন থাকবে বাংলাদেশের ওপর। রানা প্লাজার ঘটনা সামলাতে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটলে সেটি হবে চূড়ান্ত বিপর্যয়।
তবে শর্ত বা চাপের কারণে নয়, প্রয়োজনীয় কাজগুলো করতে হবে নিজেদের উদ্যোগে, নিজেদের তাগিদে। এর আগের মজুরি বোর্ডে কী হয়েছিল, মনে আছে তো? মালিকেরা মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ করে ন্যূনতম মজুরিকাঠামো কমিয়ে এনেছিলেন। তথাকথিত কিছু শ্রমিকনেতা হাত মিলিয়েছিলেন মালিকদের সঙ্গে। এবার যাতে সেটি না হয়। লোকবল নেই, তাই কারখানা পরিদর্শন করা যায় না বলে সরকারি সংস্থাগুলো বছরের পর বছর বলে আসছে। এখন পর্যন্ত কি লোকবল বাড়ানোর একটা উদ্যোগও কারও চোখে পড়েছে? বাজেটে কি এ নিয়ে একটা কথাও আছে? রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোতে (ইপিজেড) শ্রমিক ইউনিয়ন দেওয়ার প্রক্রিয়া কী হবে, কেউ কি জানে? আমিনুল ইসলামের হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার রাজনৈতিক সদিচ্ছা কি সরকারের আদৌ আছে?
‘করছি’ আর ‘করব’র দিন শেষ। এখন কাজটি ‘করে’ দেখাতে হবে। সবকিছু অস্বীকার করার প্রবণতা থেকে সরকার ও বিজিএমইএ—উভয়কেই বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে বড় সর্বনাশ সামনে আসবে। শওকত হোসেন | আপডেট: ০০:৫৮, জুলাই ০৭, ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ

Loading

রেটিং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *