গডফাদার: সবচেয়ে পছন্দ ও প্রভাবশালী সিনেমার ৫০ বছর


Reading Time: 4 minutes

তখন আসলে কারও অবস্থাই ভালো ছিল না। ইতালির মাফিয়াদের নিয়ে কার্ক ডগলাস অভিনীত সিনেমা দা ব্রাদারহুড বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ছবিটি ছিল ১৯৬৮ সালের। এরপরে প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্ট পিকচার্সের পরপর কয়েকটি সিনেমা ব্যবসাসফল হয়নি। ফলে একটা লাভজনক সিনেমার জন্য মরিয়া ছিল প্যারামাউন্ট পিকচার্স।

ইতালীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন ঔপন্যাসিক মারিও পুজো তখন জুয়ায় হেরে দেনার দায়ে জর্জরিত। যেকোনোভাবে হোক তাঁর ১০ হাজার ডলার লাগবেই। উপন্যাসটির তখন মাত্র ৬০ পৃষ্ঠা লেখা হয়েছে। প্যারামাউন্ট পিকচার্সের কাছে তারই স্বত্ব বিক্রি করে দিলেন সাড়ে ১২ হাজার ডলারে। তবে শর্ত ছিল লেখা শেষ করলে পাবেন আরও ৮০ হাজার ডলার। সেটাও ১৯৬৭ সালের ঘটনা।

প্রযোজনা সংস্থার শর্ত ছিল পরিচালক ইতালীয় বংশোদ্ভূত কেউ হতে হবে, নইলে ইতালির মাফিয়াদের মূল সুরটিই ধরতে পারবেন না। প্রথম পছন্দ ছিল সার্জেই লিওঁ। কিন্তু তিনি তখন ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন আমেরিকা নামে আরেকটি মাফিয়া বা গ্যাংস্টার সিনেমা বানাবেন বলে ঠিক করে আছেন। এরপর একে একে আরও কয়েকজন পরিচালকের কাছে গেলেন তাঁরা। কিন্তু কেউই রাজি নন। তারপর প্যারামাউন্ট গেল ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার কাছে। তিনি তখন নবীন পরিচালক, খুব খ্যাতি নেই। তবে গল্পটা কাপালার পছন্দ হলো না। তাঁর মতে, হালকা ও সস্তা গল্প। তারপরও রাজি হলেন। কারণ, তিনিও দেনায় জর্জরিত। কপোলা ও তাঁর বন্ধু জর্জ লুকাস (স্টার ওয়ার্সখ্যাত) একটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনিনির্ভর সিনেমা বানিয়েছিলেন। এ জন্য প্রযোজনা সংস্থা ওয়ার্নার ব্রাদার্স-এর কাছ থেকে ৪০ হাজার ডলার ধার করেছিলেন। কিন্তু সিনেমাটি ভালো চলছিল না। সুতরাং জর্জ লুকাসের পরামর্শে নতুন সিনেমা পরিচালনায় রাজি হলেন।

মার্লোন ব্র্যান্ডো মেজাজি অভিনেতা হিসেবে ‘কুখ্যাত’। তিনিও প্রায়ই বর্জনের তালিকায় থাকেন। সবচেয়ে বড় কথা, ’৫০–এর দশকে ব্যাপক সফল হলেও ’৬০–এর দশকে এসে তাঁর খ্যাতি নিম্নমুখী হয়ে পড়ে। তাঁর কোনো সিনেমাই সাফল্য পাচ্ছে না। এমন একজনকে নিয়ে সিনেমা বানাতে মোটেই আগ্রহী নয় প্যারামাউন্ট পিকচার্স। তাদের পছন্দ লরেন্স অলিভিয়ের।

আল পাচিনো তখন একেবারেই নবীন অভিনেতা, খ্যাতি নেই। প্রযোজনা সংস্থার চাহিদা ওয়ারেন বেটি বা রবার্ট রেডফোর্ড। আল পাচিনো নিয়ে সবচেয়ে বড় আপত্তি, তিনি তুলনামূলক খাটো। সুতরাং লম্বা কাউকে চাই।

এই হচ্ছে দ্য গডফাদার সিনেমার শুরুর গল্প। সিনেমাটির শুটিং শুরু হয়েছিল নিউইয়র্কে—১৯৭১ সালের ২ জুলাই। যার শুরুতেই এত বিপত্তি, শেষটাও যে সহজ ছিল না, তা বলা বাহুল্য। প্রযোজনা সংস্থা ও পরিচালকের মধ্যে খিটিমিটি লেগেই ছিল। বেশ কয়েকবার বরখাস্ত হওয়ার উপক্রম হয়েছিলেন কপোলা। ফলে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে দ্য গডফাদার মুক্তি পায় ১৯৭২ সালের ১৫ মার্চ। সেই হিসেবে আজ সিনেমাটির ৫০ বছর। সেই গডফাদার সিনেমাজগতের সবচেয়ে পছন্দের ও সবচেয়ে প্রভাবশালী সিনেমা হিসেবেই খ্যাত। প্রভাব ও খ্যাতিতে এর সঙ্গে কেবল তুলনা করা যেতে পারে অরসন ওয়েলস-এর সিটিজেন কেনকে।

দ্য গডফাদার মার্কিন অপরাধজগতের কাহিনি। মূল চরিত্র ইতালি থেকে আসা ভিটো কর্লিয়নি। কর্লিয়নি পরিবারের প্রধান। ভিটোর তিন ছেলে। বড় ছেলে সনিই হবে পরিবারের পরবর্তী প্রধান। মেজ ছেলে ফ্রেডো দুর্বল চিত্রের। ছোট ছেলে মাইকেল বাবার ব্যবসায় আগ্রহী নন, পড়াশোনা করছে অন্যত্র। একমাত্র মেয়ে কনির বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের বিপরীতে আছে একাধিক মাফিয়া পরিবার। আধিপত্য বিস্তার, জুয়া ও মাদক কারবার নিয়ে ঝামেলায় বড় ভাই মারা যাওয়ার পরে বাবা গুলিবিদ্ধ হলে পরিবারের দায়িত্ব নেয় ছোট ছেলে মাইকেল। শেষে দেখা যায়, মাইকেল বাবার তুলনায় আরও পরিকল্পিত, আরও নিষ্ঠুর, আরও সফল।

গল্পটা শুনলে এখন যে কেউ বলে দেবেন—এ আর নতুন কী। এ নিয়ে কত কত সিনেমা হয়েছে। আর এখানেই দ্য গডফাদার–এর মূল কৃতিত্ব। গ্যাংস্টার সিনেমা মানেই গডফাদার। পরের নামটি হয়তো মার্টিন স্করসিজের গুডফেলাস-এর। বক্স অফিসে তুমুল সাফল্য তো আছেই, প্রভাবের দিক থেকেও গডফাদার অনন্য। ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা ও আল পাচিনোর ক্যারিয়ার নির্মাণ করে দিয়েছিল এই সিনেমা, আর মার্লোন ব্রান্ডোকে দিয়েছিল নতুন জীবন। ৫০ বছর উপলক্ষে আগ্রহীরা নতুন করে দেখতে পারেন সিনেমাটি। যুক্তরাষ্ট্রে এ উপলক্ষে নতুন করে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এখনো চলছে নানা আয়োজন। এ সুযোগে কেবল রবার্ট ডি নিরোর অভিনয় দেখতেই গডফাদার টু দেখে নিতে পারেন। তাহলে গডফাদার থ্রি বাকি থাকবে কেন?

ভক্তরা কিন্তু দ্য গডফাদারকে নিছকই একটি মাফিয়া গ্যাংস্টার বলতে নারাজ। কেবল মাফিয়া কাহিনি এত খ্যাতি এনে দিতে পারত না। বরং সবাই একে একটি পারিবারিক সিনেমা বলেই মনে করেন। দ্য ফ্যামিলি বা পরিবারই সব—এটাই হচ্ছে সিনেমাটির মূল বিষয়। প্রকৃত মাফিয়াদেরও খুব প্রিয় সিনেমা গডফাদার। যদিও শুরুতে সিনেমার বিপক্ষে ছিলেন সবাই। চেষ্টা করেছিলেন শুটিং বন্ধ করতে। এর অন্যতম প্রযোজক আল রুডির গাড়িতে গুলিও করা হয়েছিল। পরে সমঝোতা হয় যে সিনেমায় মাফিয়া কথাটা উল্লেখ থাকবে না। তবে মুক্তির পরে তাঁদের এতটাই পছন্দ হয় যে মাফিয়াপ্রধানেরা ভিটো কর্লিয়নির মতো কথা বলতেন, তার মতো করেই হাঁটতেন, তার মতো করে ভাবতেন।

দ্য গডফাদার–এর অনেক সংলাপও কিংবদন্তি হয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত সংলাপ হচ্ছে, ‘আই অ্যাম গনা মেইক ইউ অ্যান অফার ইউ কান্ট রিফিউজ’। ভাবসম্প্রসারণের মতো করে এই লাইন নিয়ে হাজার হাজার লেখা পাওয়া যায়। কাজ উদ্ধারের যেকোনো আলোচনায় এই কথাটি ব্যবহার হচ্ছে বারবার। কেবল অন্য সিনেমা বা নাটকেই এই সংলাপেই ব্যবহার হয়েছে প্রায় দেড় শ বার। সবচেয়ে শক্তিশালী ও একই সঙ্গে অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটি সংলাপ বলেই মনে করা একে। ভিটো কর্লিয়নির পালিত পুত্র জনি একজন গায়ক, কিন্তু কোথাও সুযোগ পাচ্ছেন না। নতুন এক সিনেমায় গান গাইতে চান। কিন্তু স্টুডিওপ্রধান জ্যাক ওলটজ সুযোগ দিতে নারাজ। এ নিয়ে কথা উঠতেই জনিকে গান গাওয়ার সুযোগ পাবে বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন ভিটো। এরপর কীভাবে ব্যবস্থা করেছিলেন, সেটাই মূল বিষয়।

সিনেমার পরের দৃশ্যে ছিল, ঘুম থেকে উঠে স্টুডিওপ্রধান জ্যাক ওলটজ দেখলেন বিছানা রক্তে ভেসে যাচ্ছে, আর সেখানে পড়ে আছে তার প্রিয় ঘোড়ার মস্তক। বহু বছর পরে, ২০০৮ সালে ইতালির এক শহরে চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন এক খাদ্য প্রস্তুতকারী। পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন বিছানাজুড়ে অনেকগুলো গাধার মস্তক। এভাবেও অনুকরণ করা হয়েছিল দ্য গডফাদারকে। গ্রিসেলদা ব্ল্যাঙ্কো একজন কুখ্যাত মাদক কারবারি। ট্রাফিক সিনেমায় যার চরিত্রে অভিনয় করেছিল ক্যাথরিন জেটা জোনস। গ্রিসেলদা নিজের ছেলের নাম রেখেছেন মাইকেল কলিয়র্নি।

সালভেতর ‘স্যামি দা বুল’ গ্রাভানো ছিলেন কুখ্যাত মাফিয়া গ্রুপ গ্রাভানো পরিবারের প্রধান। জন গুট্টিকে খুন করেই তিনি পরিবারপ্রধানের পদ দখল করেছিলেন। অনেক পরে অবশ্য সরকারপক্ষে রাজসাক্ষী হন। তখন নিউইয়র্ক টাইমস তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিল। সে সময় সালভেতর স্বীকার করেছিলেন যে তাঁর করা একটি খুন ছিল দ্য গডফাদার–এর একটি দৃশ্যের মতোই। তিনি আরও বলেছিলেন, গডফাদার দেখার পর থেকেই তাঁরা যে দুটি কথা প্রায়ই বলতেন তার একটি হচ্ছে, ‘আই অ্যাম গনা মেইক ইউ অ্যান অফার ইউ কান্ট রিফিউজ’, অন্যটি হচ্ছে, ‘ইফ ইউ হ্যাভ অ্যান এনিমি, দ্যাট এনিমি বিকামস মাই এনিমি’। যুগ যুগ ধরে মাফিয়াদের প্রিয় সংলাপ হয়ে আছে এটি।

তখন তো আর ড্রোন ছিল না। ফলে পরিচালকেরা হেলিকপ্টার ব্যবহার করতেন। কিন্তু আধুনিক কোনো পদ্ধতি নেওয়ার পক্ষে ছিলেন না কপোলা। ফলে শুটিংয়ের সময় কোনো জুম লেন্স বা হেলিকপ্টার ব্যবহার করেননি কাপোলা। বরং ক্যামেরায় অল্প আলো ও ছায়ার ব্যবহার ছিল অনেক বেশি। সব মিলিয়ে এর সিনেমাটোগ্রাফি ছিল অসাধারণ। আর সংগীতায়োজনের কথা না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ইতালির সুরস্রষ্টা জিওভান্নি রোতা রিনালদিকে সংক্ষেপে ডাকা হয় নিনো রোতা। পুরো সংগীতায়োজন শুনলে মনেই হবে না এটি একটি মাফিয়া গ্যাংস্টার সিনেমা। মজার ব্যাপার হলো প্যারামাউন্ট পিকচার্স প্রথমে এই মিউজিক সিনেমায় রাখতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু কপোলা ছিলেন নাছোড়বান্দা। বিশেষ করে ইতালির ভাবটা আনতে তিনি এর বিকল্প কিছু পাননি। ‘ধীরলয়ে কথা বলা ও ভালোবাসা’—এই ছিল মিউজিকের মূল ভাব। ৫০ বছর উপলক্ষে তা–ও আবার শুনতে পারেন।

৫০ বছর ধরেই তো দ্য গডফাদার সিনেমার সবকিছুই উপভোগ করে আসছেন কোটি কোটি সিনেমাপ্রেমী মানুষ।

প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২২

Loading

রেটিং

Comments

  1. shakila haque

    চমতকার একটি লেখা। অনেক কিছুই জানা ছিলো না। ধন্যবাদ লেখককে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *