অর্থনীতি চাপে, ঋণখেলাপিরা আনন্দে


Reading Time: 4 minutes

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন জারি করে জাতির উদ্দেশে ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমাদের দেশের অর্থনৈতিক সংকটের একটি প্রধান দিক হলো ব্যাংকিং সেক্টরে দারুণ কারচুপি এবং দুর্নীতি। সার্বিকভাবে প্রকল্প বিশ্লেষণ না করে ও অর্থনৈতিক কার্যকারিতার বিচার ছাড়াই এবং অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ নীতিমালা অমান্য করে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান নামমাত্র ছিল। এদের প্রায় সবাই রাজনৈতিক কারণে বিভিন্ন দল বা নেতা বা পদস্থ কর্মকর্তাদের বদৌলতে তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থে এ অর্থ লাভ করে এবং জনগণের গচ্ছিত জাতীয় সঞ্চয় অপচয় করে।’

এরশাদ বিদায় নেওয়ার পর বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘ঋণ ব্যবস্থাপনা বা আর্থিক খাতে নৈরাজ্য বিরাজমান। বিপুল পরিমাণ ঋণ অনাদায়যোগ্য হয়ে পড়েছে। ঋণ ব্যবস্থাপনায় এই নৈরাজ্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সংকটাপন্ন করে তুলেছে। ঋণ আদায় না হওয়ার কারণে অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানে সম্পদের অভাব দেখা দিয়েছে এবং তারা নতুন ঋণ দিতে প্রায় অক্ষম।’

১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া বলেছিলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত অগ্রহণযোগ্য মাত্রার খেলাপি ঋণ বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে পঙ্গু করে রেখেছে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়াতে ব্যাংকসমূহকে সুদের হার বাড়াতে হয়েছে। এর ফলে দেশে বিনিয়োগ, বিশেষত নতুন উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। খেলাপি ঋণ আর্থিক খাতে পারস্পরিক অবিশ্বাসের একটি পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।’

হুবহু এই কথাগুলোই যদি আজ কেউ বলেন, একটুও ভুল হবে না। কারণ, পরিস্থিতি একই আছে।

মজার বিষয় হলো, আগে অর্থমন্ত্রীরা বাজেট বক্তৃতায় খেলাপি ঋণ নিয়ে কিছু না কিছু কথা বলতেন। কিন্তু ২০০৯ সালের পর থেকে টানা ১০টি বাজেটে খেলাপি ঋণ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি। অথচ এই কালপর্বে ঋণখেলাপি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ২২ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এই সময়ের অর্থমন্ত্রী অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ঋণখেলাপি নিয়ে কিছু বলেননি।

অবশ্য বলেছিলেন অনেক আগে, যখন তিনি অর্থমন্ত্রী ছিলেন না, তাঁর দলও ক্ষমতায় ছিল না। ১৯৯১ সালে তিনি গদিচ্যুত এরশাদ সরকারকে নিয়ে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশে ব্যাংকঋণ পরিশোধ না করাটা এখন একরকম সর্বজনীন অভ্যাস। বড় বড় ব্যবসায়ী, সফল শিল্পপতি বা গ্রামীণ মাতবর—কেউই ঋণ পরিশোধ করে না।…ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ব্যক্তিরা গোষ্ঠী হিসাবে সরকারের সহযোগী, তাই এদের মর্জিই হলো সরকারের প্রচেষ্টা। বিশেষ গোষ্ঠীকে নিজের দলে রাখতে গেলে স্বভাবতই দেশের বা জনতার স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়।’

তাঁর এই কথাগুলোও এখনকার পরিস্থিতিতে দিব্যি চালিয়ে দেওয়া যায়।

বহু বছর পরে, এবারের বাজেটে ঋণখেলাপিদের প্রসঙ্গ আবার এনেছেন নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অবশ্য এ জন্য তাঁকে বাহবা দেওয়ার খুব বেশি সুযোগ নেই। কেননা তিনি একটি ‘ভালো ঋণ সংস্কৃতি’ গড়ে তোলার লক্ষ্যে মূলত ঋণখেলাপিদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথাই বলেছেন। একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবির কথা তিনি যে দীর্ঘদিন শুনছেন, সে কথা জানিয়ে আলাপ–আলোচনা করে কিছু একটা করবেন বলেও আশ্বাস দিয়েছেন। এমনটাই তো হওয়ার কথা। কারণ, বর্তমান অর্থমন্ত্রী দায়িত্ব পেয়েই যেভাবে ঋণখেলাপিদের একের পর এক সুবিধা দিচ্ছেন, তার প্রতিফলন তো বাজেটে থাকবেই।

ঋণখেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ কী—২২ জুন সংসদে অর্থমন্ত্রীর প্রতি সংরক্ষিত নারী আসনের সদস্য বেগম লুৎফুন নেসা খানের এই প্রশ্নের উত্তরে অর্থমন্ত্রী পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন: ১. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নিয়ন্ত্রণবহির্ভূত কারণ। ২. ব্যাংক কর্তৃক যথাযথভাবে ঋণগ্রহীতা নির্বাচন না করা। ৩. ঋণের বিপরীতে রাখা অপর্যাপ্ত জামানত, একই সম্পদ একাধিক ব্যাংকে জামানত রাখা ও জামানত বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দেখানো। ৪. গ্রাহকের সব দলিল সংগ্রহ ও সঠিকতা যাচাই না করা। ৫. ঋণগ্রহীতার তহবিল ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা, প্রয়োজন ও সামর্থ্য বিচার না করেই অতিরিক্ত ঋণ দেওয়া, ঋণসীমা বাড়ানো, পুনঃ তফসিল করা এবং পুনর্গঠন সুবিধা দেওয়া।

ঋণখেলাপি বাড়লে কী সমস্যা হয়, অর্থমন্ত্রী তা–ও জানেন। তিনি বলেছেন, ঋণ খেলাপ হয়ে পড়লে ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা দেখা দেয়।

সব মিলিয়ে সংসদের ভাষায় বলা যায়, অর্থমন্ত্রীর উত্তর সঠিক হয়েছে। তবে এর সঙ্গে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণ দেওয়ার কথা বলা হলে উত্তরটা আরও নিখুঁত হতো। তা–ও মন্দের ভালো। সংসদে ওই দিন অর্থমন্ত্রী আরও বলেছেন, উৎপাদনশীল খাতসহ অন্যান্য খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখাসহ ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ হ্রাস ও দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পুনঃ তফসিল ও এককালীন এক্সিট–সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ হ্রাস পাবে বলে আশা করা যায়।

সত্যিই কি এই আশার কোনো ভিত্তি আছে? ব্যবস্থা না নিয়ে বরং ঋণখেলাপিদের বিশেষ সুবিধা দিয়ে অর্থ আদায় করা গেছে, এমন উদাহরণ অন্তত বাংলাদেশে নেই। ওই প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী নিজেই তো বলেছেন, ব্যবসায়িক প্রয়োজনীয়তা ও সামর্থ্য বিবেচনা না করে তার অনুকূলে অতিরিক্ত ঋণসুবিধাদি (যেমন নবায়ন, ঋণসীমা বৃদ্ধি, পুনঃ তফসিলীকরণ, পুনর্গঠন ইত্যাদি) প্রদান করাও খেলাপি ঋণকে উৎসাহিত করে। সুতরাং নতুন করে যে সুবিধার ফলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দীর্ঘ মেয়াদে আরও বাড়বে, এর সাম্প্রতিক উদাহরণ তো আমাদের সামনেই আছে। ২০১৫ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের কারণ দেখিয়ে ৫০০ কোটি টাকার বেশি ঋণ আছে, এমন ১১টি বড় কোম্পানির খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন স্কিম চালু করেছিল। কিন্তু সেই টাকা আর ফেরত আসেনি। এ অবস্থায় আবারও একই ধরনের সুবিধা দেওয়ার পেছনে অর্থনীতির চেয়েও রাজনীতিই বেশি ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ৩০ ডিসেম্বর যে মডেলের নির্বাচন হয়েছে, তাতে নির্দিষ্ট কিছু শ্রেণিকে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হয়তো অবধারিত ছিল। মনে করিয়ে দিই, ঋণখেলাপিরা ছাড়াও নতুন বাজেটে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন কালোটাকার মালিকেরা।

এবার একটা ফাঁকির কথা বলি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী দীর্ঘ মেয়াদে ঋণ পুনঃ তফসিল ও এককালীন এক্সিট–সংক্রান্ত বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছেন। এই সার্কুলারটি জারি করা হয় গত ১৬ মে। একই দিনে জারি করা আরও একটি সার্কুলারের বিষয়বস্তু ছিল ভালো ঋণগ্রহীতাদের প্রণোদনা দেওয়া। মূলকথা ছিল, যাঁরা ঋণ নিয়মিত ফেরত দিচ্ছেন, তাঁরা ফেরত দেওয়া ঋণের সুদের ১০ শতাংশ ফেরত পাবেন। বারবার ঋণখেলাপিদের সুযোগ দেওয়ায় সমালোচনা হচ্ছিল খুব। কেননা ঋণখেলাপিরা মাত্র ৯ শতাংশ সুদহারে কিস্তি পরিশোধের বিশেষ সুযোগ পাবেন, ভালো গ্রহীতাদের দিতে হবে ১০ শতাংশের বেশি হারে—এটা চরমতম অন্যায় ও অনৈতিক। এ সমালোচনার জবাবে একই দিনে নতুন এই সার্কুলার। আসলে এটিও নতুন কিছু নয়। ২০১৫ সালের ১৯ মার্চ ঠিক একই সার্কুলার জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন সার্কুলার সেটারই একটি কপি। সুতরাং এ নিয়েও নতুন করে বাহবা দেওয়ার কিছু নেই।

ঋণখেলাপিদের নানা সুবিধা দেওয়ার মধ্যেই আবার ২২ জুন সংসদে শীর্ষ ৩০০ ঋণখেলাপির তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। সংসদে তালিকা প্রকাশ নতুন কিছু নয়। তবে সামাজিকভাবে লজ্জা দেওয়ার এটা একটা উপায় বটে। পাশের দেশ ভারত তো ঋণখেলাপিদের ছবিও প্রকাশ করে। কিন্তু কেবল তালিকা বা ছবি প্রকাশ করে খেলাপি ঋণ খুব বেশি কমানো গেছে, এমন উদাহরণ তেমন নেই। প্রয়োজন আইনকানুনের কঠোর প্রয়োগ। কিন্তু ঋণখেলাপিদের সরকারগুলোর বারবার সুবিধা দেওয়ার যে প্রবণতা, তাতে সেই গানটির মতো করেই বলা যায়, ‘বেশি কিছু আশা করা ভুল’। অর্থাৎ ঋণখেলাপিরা সুবিধা পেতেই থাকবেন। সুতরাং ঋণখেলাপিদের কারণে অর্থনীতি চাপে থাকলেও সুবিধা পেয়ে আনন্দেই আছেন তাঁরা।

তবে যাঁরা এ নিয়ে খুব বেশি হতাশ, সান্ত্বনা পেতে তাঁদের মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কুষ্ঠরোগীর বউ’ গল্পের শুরুটা পড়তে বলি। ‘এ কথা কে না জানে যে পরের টাকা ঘরে আনার নাম অর্থোপার্জন এবং এ কাজটা বড় স্কেলে করতে পারার নাম বড়লোক হওয়া?…কম ও বেশি অর্থোপার্জনের উপায় তাই একেবারে নির্ধারিত হয়ে আছে, কপালের ঘাম আর মস্তিষ্কের শয়তানি। কারও ক্ষতি না করিয়া জগতে নিরীহ ও সাধারণ হইয়া বাঁচিতে চাও, কপালের পাঁচ শ ফোঁটা ঘামের বিনিময়ে একটি মুদ্রা উপার্জন করো: সকলে পিঠ চাপড়াইয়া আশীর্বাদ করিবে। কিন্তু বড়লোক যদি হইতে চাও মানুষকে ঠকাও, সকলের সর্বনাশ করো। তোমার জন্মগ্রহণের আগে পৃথিবীর সমস্ত টাকা মানুষ নিজেদের মধ্যে ভাগ করিয়া দখল করিয়া আছে। ছলে বলে কৌশলে যেভাবে পার তাহাদের সিন্দুক খালি করিয়া নিজের নামে ব্যাংকে জমাও। মানুষ পায়ে ধরিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে অভিশাপ দেবে। ধনী হওয়ারএ ছাড়া দ্বিতীয় পন্থা নাই।’

আসুন, আমরাও কাঁদিতে কাঁদিতে অভিশাপ দিই।

২৯ জুন ২০১৯

Loading

রেটিং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *