গণহত্যা ও রাজনীতি নিয়ে প্রিয় সিনেমা


Reading Time: 14 minutes

কখনো সক্রিয় রাজনীতি করিনি। কিন্তু নিজেকে আমি রাজনীতিবিমুখ মনে করি না। রাজনীতি আমার প্রিয় বিষয়, পঠনেও। এমনকি সিনেমা দেখার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সিনেমা আমার সবচেয়ে পছন্দের। আর সেটি যদি সত্য কোনো ঘটনা নিয়ে হয় তাহলে আরও বেশি পছন্দের। এখনও আমি খুঁজে খুঁজে রাজনীতি নিয়ে তৈরি সিনেমা কিনি এবং দেখি।
একবার সামুতে রাজনীতি, সংঘাত ও কর্পোরেট ক্রাইম নিয়ে সিনেমার একটি তালিকা করেছিলাম। সেই তালিকা পূর্ণাঙ্গ ছিল না। অনেকদিন ধরে ভাবছিলাম পূর্ণাঙ্গ একটি তালিকা করবো। সেই চেষ্টা থেকেই এই লেখা।
এবার কর্পোরেট ক্রাইম বাদ দিলাম। এই ধরণের ছবি নিয়ে আলাদা করে লেখার ইচ্ছা আছে। এবার কেবলই রাজনীতি। আর রাজনীতি থাকলে সংঘাতও থাকবে। তালিকা তৈরির ক্ষেত্রে ফিকশন বাদ দিয়েছি। আমার তালিকায় আছে সেই সব সিনেমা যার মধ্যে সত্যতা আছে। একটি লেখার মধ্যে সব সিনেমা আনা সম্ভব না। তাই পর্ব থাকছে। এটি প্রথম পর্ব।
প্রথম পর্বকে গণহত্যা পর্বও বলা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে গণহত্যা হয়েছে। এসব গণহত্যা নিয়ে তৈরি সিনেমার সংখ্যাও কম নয়। প্রথম পর্ব সেইসব সিনেমার সংখ্যাই বেশি। গণহত্যা ছাড়াও গৃহযুদ্ধও স্থান পেয়েছে এই তালিকায়।

১. আরারাত: ১৯১৫ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের শেষ সময়ে তুর্কিরা যে গণহত্যা চালিয়েছিল তাকে বিশ শতকের প্রথম গণহত্যা বলে উল্লেখ করা হয়। এ সময়ে ১৫ লাখ আর্মেনীয়কে হত্যা করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঠিক পর পর এই গণহত্যা হয়েছিল। তুরস্ক দীর্ঘদিন ধরে এই গণহত্যা অস্বীকার করে আসছে। তারা বলে আসছে যে, অটোমান সাম্যাজ্য ভাঙ্গার সময়ে গণ অসন্তোষের কারণে হত্যা ও মৃতের সংখ্যা বেড়েছিল।
মূলত আর্মেনীয়দের নিশ্চিহ্ন করতে পরিকল্পিত ভাবে এই হত্যাযজ্ঞ চালনো হয়েছিল। প্রথমে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। বাকিদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয় কাছের মরুভূমিতে। পথে অনাহারে ও অত্যাচারে মারা যায় আরও অনেকে। বাকিদের মরুভূমিতে হত্যা করা হয়েছিল।
ভান উপত্যাকায় সংগঠিত গণহত্যা নিয়ে ছবি আরারাত। আরারাত সেখানকার একটি পাহারের নাম। ঐ এলাকার একজন খ্রীশ্চান পাদ্রীর লেখা কিছু নোট এবং গণহত্যা থেকে বেচে যাওয়া একজন চিত্রশিল্পীকে কেন্দ্র করে ছবিটি তৈরি। বলা যায় একটা সিনেমার মধ্যে এক সিনেমা। আর্মেনীয় একজন পরিচালক সেই গণহত্যা নিয়ে ছবি করার পরিকল্পনা নেয়। সেই সিনেমা তৈরি এবং আনুসাঙ্গিক কিছু ঘটনা নিয়ে এই সিনেমা।

Ararat_movie_0.jpg


আর্মেনীয় গণহত্যার সঙ্গে বাংলাদেশের গণহত্যার অনেক মিল। পাকিস্তানিরা যেমন স্বীকার করে না, তেমনি তুরস্কও স্বীকার করে না। আজও আর্মেনীয়রা লড়ছে সেসময় যে গণহত্যা হয়েছিল তার স্বীকৃতি পেতে।
এবার বাড়তি কিছু তথ্য। আর্মেনীয় গণহত্যা শুরু হয়েছিল প্রায় ২৫০ জন বুদ্ধিজীবী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও হত্যাকে কেন্দ্র করে। এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল তখনকার অটোমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তালাত পাশা। আর্মেনীয় গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া সঘোমন তেহলিরিয়ান ১৯২১ সালে জার্মানির বার্লিনে প্রকাশ্য দিনের আলোয় জনসম্মুখে তালাত পাশাকে খুন করে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে এই প্রতিশোধের বিচার। অসংখ্য সাক্ষী থাকা সত্বেও বিচারকরা সঘোমন তেহলিরিয়ানকে মুক্তি দিয়েছিলেন। কারণ তিনি এমন একজনকে খুন করেছেন যিনি ১৫ লাখ মানুষকে খুনের আদেশ দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশে যারা গো আজম-নিজামীদের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে যুক্তি তোলেন তাদের এই তথ্যটি মনে রাখা প্রয়োজন।

২. কিলিং ফিল্ডস: কম্বোডিয়ার খেমার রুজদের সেই সময়কার ঘটনা নিয়ে ছবি। তথাকথিত কমিউনিষ্ট এই খেমার রুজ, যারা ইতিহাসে ধিকৃত অন্তত ৩০ লাখ মানুষের গণহত্যার জন্য। কম্বোড্য়িায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। কমিউনিষ্ট পার্টি অব কাম্পূচিয়ার অনুসারীদেরই খেমার রুজ বলা হত।
১৯৭৫ সালের ১৭ এপ্রিল সরকারী বাহিনীকে পরাস্ত করে খেমার রুজ গেরিলারা কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেন দখল করে নিয়েছিল। খেমার রুজ গেরিলাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পলপট। খেমার রুজ গেরিলারা নমপেন দখল করার পলপট সরকার কম্বোডিয়ার নামকরণ করে “ডেমোক্রেটিক কাম্পূচিয়া”। তারপর মূলত কৃষি সংস্কারের নামে ভয়ঙ্কর হত্যাযজ্ঞ চালায় এই সরকার।

220px-The_Killing_Fields_film_0.jpg


মজার ব্যাপার হচ্ছে মার্কিণ বিরোধিতার নামে নমপেন দখল করলেও এই খেমার রুজরা ছিল সিআইএ মদদপুষ্ট। সীমান্তের দেশ ভিয়েতনামের বিরোধীতার জন্য সিআইএ খেমার রুজদের সাহায্য করেছিল। পরে ভিয়েতনামের হাতেই পতন ঘটেছিল খেমার রুজদের।
দি কিলিং ফিল্ডস সিনেমাটির শুরু ১৯৭৩ সাল থেকে। তখনও খেমার রুজরা নমপেন দখল করেনি। এরপর আবার কাহিনী চলে যায় ১৯৭৫ সালে, যখন খেমার রুজরা ক্ষমতা দখল করে। মার্কিন সাংবাদিক সিডনি স্যেনবার্গ খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে আটকে পরে নমপেনে। সঙ্গী দোভাষী ডিথ প্রান। কিভাবে সেখান থেকে বের হয়ে আসে সেটাই মূলত সিনেমা। খেমার রুজদের গণহত্যার দলিল এই ছবিটি।

৩. কাতিন: ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মান দখল করে পোল্যান্ডের একটি অংশ। আর ১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত রেড আর্মি দখল করে নেয় পোল্যান্ডের পূর্বাংশ। রেডআর্মি কিছুটা বাঁধার মুখে পড়েছিল। এসময় সাড়ে ৪ লাখ যুদ্ধবন্দী থাকলেও পরে ৪০ হাজার রেখে বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সোভিয়েত ইন্টানন্যাল সিকিউরিটি সার্ভিস বা এনকেভিডির (আসলে সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশ) হাতে যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দেওয়া হয়। তাদের নেওয়া হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন জায়গায়। বন্দীদের তালিকায় সেনা সদস্য ছাড়াও ছিল শিক্ষক, ডাক্তার, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। ১৯৩৯ এর অক্টোবর থেকে ১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদ চলে তাদের উপর। এর উদ্দেশ্য ছিল আসলে কে বাঁচবে আর কে মরবে সেটি নির্ধারণ করা। যাদের মধ্যে সামান্যতম সোভিয়েত বিরোধী মনোভাব পাওয়া গেছে তারাই তালিকাভূক্ত হয়।
পিপলস কমিশার ফর ইন্টারনাল অ্যাফেয়ার্স ও ফার্স্ট র্যাংক কমিশার অব স্টেট সিকিউরিটি ল্যাভরেনিটি বেরিয়া ১৯৪০ সালের ৫ মার্চ স্টালিনসহ সোভিয়েত পলিটব্যুরোর সব সদস্যের কাছে একটি নোট পাঠায়। তাতে যুদ্ধবন্দীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ ছিল। পলিটব্যুরো তাতে সম্মতি দেয়। ১৯৪০ সালের ৩ এপ্রিলের পর থেকে অল্প সময়ের মধ্যে ২২৪৩৬ জনকে মেরে ফেলা হয় ঠান্ডা মাথায়, আয়োজন করে। তখন গুপ্ত পুলিশের চিফ এক্সিকিউশনার ভাসিলি মিখাইলোভিচ ব্লোখিন একাই গুলি করে মেরেছে ৬ হাজার পোলিশ বন্দীকে।

220px-Katyn_movie_poster.jpg


১৯৪১ সালে জার্মানি রাশিয়া আক্রমন করে। ১৯৪২ সালে কিছু পোলিশ রেলশ্রমিক কাতিনে গনকবর আবিস্কার করলেও বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া হয়। ১৯৪৩ সালের এপ্রিলে কাতিন জার্মানের দখলে চলে গেলে তারাই গণকবর আবিস্কার করে। পোলান্ডের প্রবাসী সরকার তখন লন্ডনে। এই সরকার ১৯৪৩ সালে বিষয়টি নিয়ে সোভিয়েত ব্যাখ্যা দাবি করলে স্টালিন পাল্টা দাবি করে যে পোলান্ডের এই সরকার নাজীদের সাথে হাত মিলিয়েছে। তারপর স্টালিন আরেকটি প্রবাসী সরকার (মস্কো ভিত্তিক) সমর্থন দেওয়া শুরু করে। সেসময় লন্ডন প্রবাসী পোলিস প্রধানমন্ত্রী সিকোরসকি ইন্টারন্যাশনাল রেড ক্রসের মাধ্যমে তদন্ত চেয়েছিলেন। ১৯৪৩ সালের ৩ জুলাই এক বিমান দূর্ঘটনায় মেয়েসহ তিনি মারা যান। মনে করা হয় এর সঙ্গেও সোভিয়েতের হাত ছিল।
১৯৪৩ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আবার কাতিন সোভিয়েতের দখলে চলে আসে। দখল পেয়েই শুরু হয় পুরো ঘটনা ভিন্নখাতে নিয়ে জার্মানির উপর চাপিয়ে দেওয়ার কাজ। যুদ্ধের পর বিষয়টি আবারো ধামাচাপা দেওয়া হয়। নুরেমবার্গ ট্রায়ালে এটি প্রথমে স্থান পেলেও পরে তা বাতিল করা হয়।
সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম ১৯৯০ সালে স্বীকার করে যে কাতিন হত্যাকান্ডের জন্য দায়ী তারাই। গর্ভাচেভ তখন ক্ষমতায়। জানানো হয় এটি ছিল সোভিয়েত গুপ্ত পুলিশের কাজ। তবে বিষয়টির সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। কে দায়ী সেটি সুনির্দিষ্ট ভাবে বলতে নারাজ রাশিয়া। এমনকি এটিকে গণহত্যা বলতেও রাজী না। পোলান্ড রাশিয়ায় এসে তদন্ত করতে চাইলেও তাতেও রাজী নয় তারা।
ইতিহাসবিদরা মনে করেন এই গণহত্যার কারণ একটিই। আর সেটি হচ্ছে-পোল্যান্ড সোভিয়েতের সীমান্তের দেশ। তারা চায়নি সীমান্তে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পোল্যান্ড টিকে থাকুক। যারাই পোল্যান্ডকে শক্তিশালী দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবে তাদেরই মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়।
বাংলাদেশের কথা মনে পড়ছে?
কাতিন পোলিশ ছবি, পরিচালক আন্দ্রে ওয়াজদা (Andrzej Wajda)। ২০০৭ সালের ছবি।

৪. মিসিং-১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ক্যু হয়েছে চিলিতে। চিলির প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দেকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল অগাস্টো পেনোসে ক্ষমতা দখল করে কমিউনিস্ট বিরোধী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, যা ছিল ১৯৯০ পর্যন্ত। ক্যুতে খুন হন আলেন্দে।
এই দিন মার্কিন সাংবাদিক চার্লস হরমান ফিরছিলেন চিলিতে। আসতে গিয়ে পথে তিনি হয়তো সাক্ষী হয়েছিলেন এই ক্যুর। দেখে ফেলেছিলেন কিছু। তাই আর বাসায় ফিরতে পারেননি তিনি। চিলিতে ছিল বউ সিসি স্পাসেক। আমেরিকা থেকে ছেলের খোঁজে চলে আসলো বাবা জ্যাক লেমন। তারপর খোঁজার পালা।

220px-Missing_1982_film.jpg


এখানেই তৈরি দৃশ্য আর ক্যুর সময় তোলা ডকুমেন্টশন এক করে দিয়েছেন পরিচালক কোস্তা। স্টেডিয়ামে আটক হাজার হাজার চিলিবাসী বা নদীতে ভেসে যাওয়া লাশ-মনে করিয়ে দেয় ৭১ কে।
বাবা এবং ছেলের বউ ঠিকই খুঁজে খুঁজে এই ক্যুর পেছনে মার্কিন দূতাবাস ও সিআইএর হাত বের করে ফেলতে শুরু করলে এক পর্যায় পাওয়া গেছে বলে ছেলের লাশ ফেরত দেওয়া হয় বাবা ও স্ত্রীকে।
এখন কে না জানে এই ক্যুর পেছনে ছিল সিআইএ। বাবা পরে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন, কিন্তু রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার স্বার্থে সেই মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। সত্য ঘটনা নিয়ে ছবি এই মিসিং।
আরেকটা তথ্য দিই, সেসময়ের চিলির মার্কিন রাষ্ট্রদূত নাথানিয়েল ডেভিস কোস্তা গাবরাসের বিরুদ্ধে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতিপূরণ মামলা করেছিলেন।

৫. শুটিং ডগস: রোয়ান্ডার গণহত্যা নিয়ে ছবি। ইকোল টেকনিক অফিসিয়াল রোয়ান্ডার একটা মাধ্যমিক স্কুল। এটি চালায় ফাদার ক্রিস্টোফার। আর শিক্ষক হিসেবে লন্ডন থেকে চলে এসেছে জো, এক আদর্শবাদি যুবক। ১৯৯৪ সালে ১১ এপ্রিল রোয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট খুন হলে শুরু হয় গণহত্যা। হুতুরা সংখ্যাগরিষ্ট। তাদের হাতে মারা যায় টুটসিরা। জাতিসংঘ বাহিনী তখন ছিল রোয়ান্ডায় মতা ভাগাভাগি পর্যবেক্ষনে। গণহত্যা শুরু হলে স্কুলে ক্যাস্প করে জাতিসংঘ মিশন। একরাতে এখানে আশ্রয় নেয় আড়াই হাজার টুটসি। বাইরে তখন চলছে গণহত্যা। দৃশ্যটা এরকম-ক্যাম্পের ঠিক একশ গজের বাইরেই উল্লাস করছে হুতুরা, সবার হাতে এক-৪৭, রামদা, কুড়াল ইত্যাদি। বের হলেবা হত্যা। সারা শহর জুড়ে তখন এই হত্যা উৎসব। স্কুলের গাড়ি চালাতো যে তাকেও দেখা গেল রামদা হাতে। এখানে আশ্রয় নিয়েছে আরো কিছু সাদা চামড়া। সাংবাদিকও আছে।

220px-Shooting_dogs.jpg


সবার চোখের সামনে চলছে গণহত্যা। কেউ কিছু করছে না। ইউএন মিশনও না। তাদের নাকি খালি পর্যবেক্ষণ করার আদেশ, গুলি করার আদেশ নাই। একসময় সব সাদা চামড়াকে বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়। থেকে যায় ফাদার ক্রিস্টোফার ও জো। তারা অসহায় টুটসিদের ছেড়ে যাবে না। এক সময় জাতিসংঘ মিশনের কাছেও অর্ডার আসে ক্যাম্প ছেড়ে দেওয়ার। তারা চলে যাবে। টুটসিদের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় জাতিসংঘ বাহিনীই যেন তাদের মেরে রেখে যায়, তারা হুতুদের হাতে মরতে রাজি না। চলে যায় মিশন। এবার আর জো পারে না। আদর্শবাদী ভাবনা ছেড়ে মৃত্যু ভয়ে সেও চলে যায় মিশনের সাথে। থেকে যায় শুধু ফাদার ক্রিস্টোফার। জাতিসংঘ বাহিনী আড়াই হাজার টুটসিদের হুতুদের হাতে ছেড়ে দিয়ে চলে যায় রোয়ান্ডা ছেড়ে।
বিবিসি প্রোডাকশনের ছবি। পুরো ঘটনাটিই সত্যি। ১৯৯৪ সালের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে গণহত্যার শিকার হয় ৮ থেকে ১০ লাখ টুটসি। ছবিটার শুটিং করা হয়েছে রোয়ান্ডার সেই সব স্থানে যেখানে গণহত্যা হয়। অরিজিন্যাল জায়গাগুলোইতেই শুটিং হয় এবং টেকনিশিয়ানরাও ছিল এমন টুটসি যাদের আত্মীয় স্বজন মারা গেছে এই সময়। এমনকি ধর্ষনের শিকার একজনও ছিল ছবিটার সঙ্গে।

৬. হোটেল রোয়ান্ডা: রোয়ান্ডার গণহত্যা নিয়ে সেরা ছবি। যাকে বলে আফ্রিকান সিন্ডার্স লিস্ট। গণহত্যা নিয়েও অন্যতম সেরা ছবি বলা হয় হোটেল রোয়ান্ডাকে। আবার ছবিটা নিয়ে সমালোচনাও আছে। যেমন রোয়ান্ডায় সে সময় অবস্থানরত ইউনাইটেড ন্যাশন অ্যাসিসট্যান্স মিশন ফর রোয়ান্ডা (ইউএনএএমআইএর)-এর ভূমিকা নিয়ে। বলা হয় তারা আসলে গণহত্যা থামাতে তেমন উদ্যোগ নেয় নাই। তাদের ভূমিকা ছবিটাতে সঠিকভাবে আসেনি।

220px-Hotel_Rwanda_movie.jpg


হোটেল কর্মকর্তা পল একজন হুতু, তার বউ টুটসি। পল জীবন বাজী রেখে রক্ষা করেছিল হোটেলে আশ্রয় নেওয়া কয়েকশ টুটসিকে। এটা নিয়েই ছবি হোটেল রোয়ান্ডা। ২০০৪ এটি মুক্তি পায়।

৭. হ্যারিসনস ফ্লাওয়ারস: মূলত এটা একটা ফ্রেঞ্চ ছবি। নিউজউইকের পুরস্কার পাওয়া ফটো সাংবাদিক হ্যারিসন লয়েড। ১৯৯১ সালে যায় যুগোস্লাভিয়ায় ছবি তুলতে। তখন সেখানে চলছে সার্ব বাহিনীর অত্যাচার। খবর আসে যে হ্যারিসন মারা গেছে যুদ্ধের সময়। বিশ্বাস করে না বউ সারা। সাংবাদিক পরিচয়ে চলে যায় যুগোস্লাভিয়ায়। এক সময় ফিরিয়ে আনে হ্যারিসনকে।

220px-Harrison's_Flowers_film_poster.jpg


কাহিনী সত্যি না। কিন্তু ঐ সময় যুগোস্লাভিয়ায় প্রায় ৪০ জন সাংবাদিক নিহত হয়েছিল। যে ম্যাসাকেরর বিভৎস দৃশ্য আছে সেটি আসলেই ঘটেছিল। ১৯৯১ সালের ১৮ থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত সিভিলিয়ানদের উপর যে ম্যাসাকার হয়েছিল তা এখন ইতিহাস। ছবিটা সেটি নিয়েই।

৮. সালভাদর: সালভাদরের গৃহযুদ্ধ চলেছিল ১২ বছর, ১৯৮০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত। এসময় মারা যায় প্রায় ৭৫ হাজার মানুষ। দেশটির সেনা সমর্থিক সরকার ও বামপন্থী ৫ টি দলের সমন্বয়ে গঠিত Farabundo Martí National Liberation Front (FMLN) এর মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল।

220px-Salvadorposter.jpg


বলাই বাহুল্য যে, সেনা সমর্থিত সরকারের সমর্থক ছিল যুক্তরাষ্ট্র। সেই সময়ের ঘটনা নিয়ে অলিভার স্টোনের ছবি সালভাদর। যুদ্ধ শেষ হলে একটি ট্রুথ কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনের কাছে লিপিবদ্ধ আছে কিভাবে হাজার হাজার মানুষের হত্যা হয়েছিল লাতিন আমেরিকার এই দেশটিতে।

৯. আমু: এবার একটা ভারতীয় ছবি, ভাষা ইংরেজি। আমু ছবিটার নাম।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে মারা যায় ৮৪ এর ৩১ অক্টোবর। এর পরের দুইদিন দিল্লী ও উত্তর প্রদেশের কিছু এলাকায় যা ঘটে তাকে আসলে দাঙ্গা বলা যায় না, বরং বলা চলে নির্বিচার হত্যা। কংগ্রেস নেতারা সদ্য তৈরি ভোটার তালিকা হাতে নিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করেছে শিখ পুরুষদের। ট্রেন থামিয়ে টেনে বের করে আনা হয় শিখদের। পুড়িয়ে মারার জন্য কেরোসিন সরবরাহ করা হয়েছিল স্থানীয় কংগ্রেস নেতারাই। বলা হয় পাঁচ হাজারের বেশি শিখকে হত্যা করা হয়েছিল সেই দাঙ্গায়। এমনকি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পুলিশও সহায়তা করেছিল এই কাজে।

220px-Amu_poster_small.jpg


কংগ্রেসের জন্য এখনও একটি কলঙ্কের নাম সেই শিখ হত্যা। পরে এ নিয়ে অনেকগুলো তদন্ত কমিটি হয়েছিল। প্রকাশ পেয়েছিল জড়িত বা প্রত্ক্ষ মদদদাতা অনেক কংগ্রেস নেতাদের নাম। যেমন জগদিশ টেইলর। এমনকি সে সময়কার পুলিশ প্রধানকেও দায়ী করা হয়েছিল। একথা প্রমানিত যে, কংগ্রেস নেতারাই এই ঘটনা ঘটায়।
সরকারি ভাবে এখনও কারো বিচার না হলেও কিছু ক্ষেত্রে বদলা ঠিকই নিয়েছে শিখরা। খালিস্তান কমান্ডো ফোর্স ১৯৮৫ সালে কংগ্রেস নেতা ও পার্লামেন্ট সদস্য ললিত মাকানকে মেরে ফেলে। যে ২২৭ জনের নাম দায়ী হিসেবে বের হয়েছিল তাতে তিন নম্বর ছিল এই ললিট মাকানের নাম। আরেকজন দায়ী কংগ্রেস নেতা অর্জন দাসকেও একই ভাবে হত্যা করে এই ফোর্স।
সেই সময়ের ঘটনার প্রভাব নিয়ে এই ছবি। কঙ্কনা, ছবিতে যার নাম কাজু, আমেরিকায় থাকে। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরেছে। কাজুর মা একজন সিংগেল মাদার, দত্তক নেওয়া মেয়ে কাজু। ১৯৮৫ সালে ম্যালেরিয়ায় বাবা-মা মারা গেলে বেঁচে যাওয়া কাজুকে দত্তক নেয় তার এখনকার মা।
কাজু জানে সে দরিদ্র্য ঘরের মেয়ে, বস্তিতে বড় হয়েছে। নিয়তি তাকে নিয়ে যায় সেই বস্তিতে। কাজু বাবা-মার পরিচয় খুঁজতে থাকে। জানতে পারে আসলে সে সময় ম্যালেরিয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ধীরে ধীরে উম্মোচিত হয় আরেক ইতিহাস। কাজু আসলে শিখ বাবা-মার মেয়ে। তাঁর বাবা মারা যায় ১৯৮৪ এর দাঙ্গায়।
সেই ইতিহাস খুঁজে পেতেও কষ্ট করতে হয় কাজুকে। আসলে কাজুর নাম ছিল অমৃতা। তাঁর ছোটো ভাই আমু বলে। সে কারণেই ছবির নাম আমু। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি এক দাঙ্গা উম্মোচনের অসাধারণ এক কাহিনী আমু।

১০. জাজমেন্ট অ্যাট নুরেমবার্গ: সবশেষে গণহত্যার বিচারের ছবি। ১৯৪৩ সালের শেষ দিকে তেহরানে বসেছিল ত্রিপক্ষীয় নৈশ ভোজ সভা। ছিলেন স্টালিন, রুজভেল্ট আর চার্চিল। ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ জার্মান অফিসারকে বিচার করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন স্টালিন। আপত্তি জানান চার্চিল। তার কথা ছিল যে সব সৈন্য তার নিজ দেশের পক্ষে যুদ্ধ করেছে তাদের ঠান্ডা মাথায় ফাঁসিতে ঝুলানো ঠিক হবে না। এর পরিবর্তে যুদ্ধের জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার করার প্রস্তাব দেন তিনি।
এরপরই ইউএস ট্রেজারি সেক্রেটারি হেনরি মর্গেনথাউ জুনিয়রের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিচার বসে জার্মানিরই নুরেমবার্গে। বলা হয়েছিল যেখানে অপরাধ ঘটেছে সেখানেই বিচার হতে হবে। ১৯৪৫ এর ২০ নভেম্বর বিচার শুরু হয়। প্রায় ২শ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়েছিল। ১৯৪৯ পর্যন্ত তা চলে।
ছবির শুরুটা মার্কিন জাজ ডান হাওয়ার্ডের নুরেমবার্গ পৌছানোর মধ্য দিয়ে। এই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন স্পেনসার ট্রেসি। যুদ্ধাপরাধী চার বিচারকের একজন ড. আর্নস্ট জেনিং (বার্ট লানকাসটার)। জুডি গারল্যান্ড ও মন্টোগোমারি ক্লিফট ছোট্র দুই চরিত্রে অভিনয় করলেও তাদের অসাধারণ অভিনয়ের রেশ সহজে যায় না। আর আছে জার্মান অভিনেতা, অভিযুক্তদের পরে আইনজীবী হান্স রোলফ (ম্যাক্সিমিলিয়ান স্কেল), সেরা অভিনেতার অস্কার পেয়েছিলেন।
বিচার হয়েছিল মূলত দুটি ঘটনা নিয়ে। ঘটনা দুটি সত্যি। একটি হলো একজন হিটলার বিরোধীকে (মন্টোগোমারি ক্লিফট) নপুংশক করা এবং আরেকটি হলো একজন ইহুদির সঙ্গে সম্পর্ক রাখায় জুডি গারল্যান্ডকে শাস্তি দেওয়া নিয়ে।

220px-170592-Judgment-at-Nuremberg-Posters.jpg


ছবিতে আর্নেষ্ট জেনিং যখন স্বীকার করে নেয় যে সে অপরাধী, বিচার করে তাদের পাঠনোদের ক্যাম্পে কি করা হতো তা তাদের জানার কথা নয়। এই কথা বলে দায় এড়াতে পারে না সে। অভিযুক্তদের আইনজীবি তখন বলেছিলেন, জেনিং অপরাধ স্বীকার করে নেওয়ায় বাকি তিন বিচারকও দোষী হয়ে পড়বেন। দোষী যদি তারা হন, তাহলে হিটলারের সঙ্গে চুক্তি করায় রাশিয়াও দোষী, চার্চিল হিটলারকে এক সময় প্রশংসা করায় চার্চিলও দায়ী, আর দায়ী মার্কিণ পুজিবাদিরা, যারা হিটলারকে অস্ত্র বিক্রি করে লাভবান হয়েছিলেন। বিচার করলে সবাইকে করতে হবে। ছবিতে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের একটা ডকুমেন্টারি বিচার কার্যের সময় দেখানো হয়।
ট্রায়াল রুমে প্রথমেই দেখায় বসে আছে অভিযুক্ত চার বিচারক। জার্মানীর চার বিচারক সরাসরি কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তারপরেও তাদের যাবজ্জীবন হয়েছিল। অপরাধ -তারাই নিরাপরাধদের বিচারের নামে ক্যাম্পে পাঠাতেন আর সেখানে তাদের ভাগ্যে কি ঘটতো তা তো সবারই জানা।

এবার রাজনীতি পর্ব

এবারের পর্বটিও সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি সিনেমা নিয়ে। তালিকার ৯টি ছবির ঘটনা পুরোপুরিই সত্য। একটিতে ভিন্ন একটি ব্যাখ্যা রয়েছে। তবে যেহেতু কেনেডি হত্যা রহস্য উদ্ধার হয়নি, তাই তালিকায় স্থান পেলো সিনেমাটি। যেসব ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিতে বড় ধরণের ধাক্কা দিয়েছিল, সে সব ঘটনার ছবি নিয়েই এই আয়োজন।

১.জেড: রাজনীতি নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে গ্রীক পরিচালক কস্তা গরভাস সম্ভবত পরিচালকদের মধ্যে প্রথম সারিতেই থাকবেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি জেড। মূলত একটি হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে ছবিটি।

CostaGavrasZ.jpg


গ্রেগরিস ল্যামব্রাকিস নামের গ্রীক রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার কর্মী প্রকাশ্যে গুপ্ত ঘাতকের হাতে খুন হয়েছিলেন ১৯৬৩ সালে। চরম ডানপন্থী দুজন কর্মী খুন করলেও তাদের পেছনে ছিল পুলিশ বাহিনীসহ আরও অনেকে। এই খুন গ্রীসের রাজনীতিতে বড় ধরণের সংকট তৈরি করেছিল। তদন্ত শুরু হলে বের হয়ে আসে একের পর এক সত্য ঘটনা। ফলে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিল সে সময়ের সরকার। নির্বাচনের তারিখও দেওয়া হয়েছিল। ল্যামব্রাকিসের বামপন্থী দল যখন নির্বাচনের জয়লাভ করবে বলে সবাই নিশ্চিত ছিল সে সময় গ্রীক সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে। বলা হয় এর পেছনে মার্কিন হাত ছিল।
জেড একটি ক্লাসিক ছবি হিসেবে বিবেচিত। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৯ সালে।

২. অল দি প্রেসিডেন্টস ম্যান:
বিখ্যাত ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে ছবি। এর ফলে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। আর ঘটনাটি উদঘাটন করেছিল দুই সাংবাদিক, যারা ইতিহাসের অংশ হয়ে আছেন।

220px-All_the_president's_men.jpg


১৯৭২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময়ে ক্ষমতাসীন রিপাবলিকান দল ও প্রশাসনের কয়েকজন মিলে ওয়াশিংটন ডিসির ওয়াটারগেটে ডেমোক্রাটদের সদর দপ্তরে আড়িপাতার যন্ত্র বসিয়েছিল। ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং কার্ল বার্নস্টেইন এই ঘটনার পেছনে কারা ছিলেন তা ফাঁস করে দিয়েছিলেন। আর তাদের খবরের উৎস ছিল ডিপথ্রোট নামের একজন সোর্স। রবার্ট রেডফোর্ড ও ডাস্টিন হফম্যান এই সাংবাদিকের ভূমিকায় অভিনয় করেন।

৩. ফ্রস্ট/নিক্সন: নিক্সন পদত্যাগ করে চুপচাপ আছেন। ১৯৭৭ সাল। ডেভিড ফ্রস্ট তখন বিখ্যাত কেউ না। ঠিক করলেন নিক্সনের একটা সাক্ষাৎকার নিতে হবে। নিক্সন তখন একপ্রকার নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। গ্লানিময় জীবন। দেশের মানুষ পছন্দ করে না। ইতিহাসের অন্যতম সেরা কেলেঙ্কারির জন্মদাতা সে। এই নিক্সন রাজী হলেন ফ্রস্টটে সাক্ষাৎকার দিতে। তবে এ জন্য দর হাকলেন ৬ লাখ ডলার। শর্ত হচ্ছে ৪টা পর্ব হবে চার বিষয়ে। ওয়াটারগেট, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ নীতি ও ব্যক্তি নিক্সন। এর মধ্যে ওয়াটারগেট কোনো ভাবেই মোট সাক্ষাৎকারের ২৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না।

220px-Frost_nixon.jpg


নিক্সন ভাবলেন এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি আবার নিজের ইমেজ উদ্ধার করবেন। ফ্রস্ট তার সাথে কথায় পারবে না বলেই সবার ধারণা। বিষয়টি সহজ ভাবে নিলো না আমেরিকানরাও। তারা মনে করে, যে লোকটির জেলে থাকা উচিৎ সেই লোককে ধনী করে দিচ্ছে ফ্রস্ট। ফ্রস্টের তখন জীবন-মরণ সমস্যা।
শুরু হলো মনস্তাত্বিক খেলা। সাক্ষাৎকারে সুবিধা করতে পারছে না ফ্রস্ট। নিক্সন বলা যায় দাঁড়াতেই দিলো না ফ্রস্টকে। ফ্রস্ট শিবিরে চরম হতাশা। বাকি আছে ওয়াটারগেট পর্ব। শুরু হলো আসল খেলা।
১৯৭৭ সালে এই চার পর্বের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি দেখা সাক্ষাৎকারের রেকর্ড এটি। এ থেকে ফ্রস্টের আয় হয়েছিল ১০ লাখ ডলার।

৪. চার্লি উইলসন ওয়ার:
আফগান মুজাহেদিন পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে যথেষ্ট পরিমাণ যন্ত্রণা দিলেও তাদের বেড়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল যুক্তরাষ্ট্রেরই। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করার জন্য আফগান মুজাদেহিনদের অস্ত্র দেওয়াসহ সব ধরণের সহায়তা করেছিল মার্কিনীরা।

220px-Charliewilsonwarposter.jpg


আফগান মুজাদেহীনদের সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ব্যবহারের ধারণা এসেছিল মার্কিণ কংগ্রেসম্যান চার্লি উইলসনের মাথা থেকে। আর সঙ্গে তো সিআইএ ছিলোই।
মাইক নিকোলস এর এই ছবিটি ২০০৭ সালের। অভিনয়ে টম হ্যাঙ্কস, জুলিয়া রবার্টস ও ফিলিপ সিমুর হফম্যান।

৫. দি পেন্টাগন পেপার্স:
ভিয়েতনাম যুদ্ধের অন্যতম রূপকার ছিলেন রবার্ট ম্যাকনামারা। ১৯৬৭ সালে ম্যাকনামারা ছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী। সে সময়ে তিনি ভিয়েতনাম-মার্কিন সম্পর্ক ও যুদ্ধ নিয়ে একটি ভিয়েতনাম স্টাডি টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন। অত্যন্ত গোপনে এটি করা হয়েছিল। এমনকি সেসময়ের প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনও তা জানতেন না। এই স্টাডি গ্রুপ ৭ হাজার পৃষ্ঠার একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল, যার ৪ হাজার পৃষ্ঠাই ছিল কেবল গোপন দলিল। রিপোর্টে দেখানো হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে একের পর এক মিথ্যা কথা বলে ভিয়েতনামে যুদ্ধ শুরু করেছিল। মার্কিন সরকার কেবল দেশের মানুষকেই মিথ্যা বলেনি, কংগ্রেসকেও মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল। এই রিপোর্টটিরই নাম পেন্টাগন পেপার্স।

the_pentagon_papers_2003.jpg


এই রিপোর্টটি ফাঁস হয়ে যায়। ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমস-এ। ড্যানিয়েল এলসবার্গ নামের একজন মিলিটারি এনালিস্ট এটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সে সময়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল এবং পরবর্তীতে নিক্সন সরকার মামলাও করেছিল পত্রিকা ও এলসবার্গের বিরুদ্ধে। সেটি নিয়েই ছবি দি পেন্টাগন পেপার্স, ২০০৩ সালের এই ছবিটিও চমৎকার।

৬. থার্টিন ডেজ:
১৯৬২ সালে ৩য় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় লেগেই গিয়েছিল। কিউবার মিসাইল সংকট নিয়ে এই যুদ্ধ লাগার উপক্রম হয়েছিল। কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে উৎক্ষাৎ করার একের পর এক চেষ্টা বিফলে যাওয়ায় মরিয়া হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আশঙ্কা ছিল কিউবা আক্রমন করে দখল নেওয়ার। যুক্তরাষ্ট্রকে ঠেকানোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন কিউবায় অনেকগুলো মিসাইল স্থাপন করেছিল। এসব মিসাইল দিয়ে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের একটি বড় অংশ ধংস করা সম্ভব ছিল। এই মিসাইল স্থাপন নিয়ে শুরু হয় সংকট।

220px-Thirteen_days_poster.jpg


জে এফ কেনেডি তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর নিকিতা ক্রুশ্চেভ সোভিয়েত প্রিমিয়ার। মজার ব্যাপার হচ্ছে দুদেশের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল এবিসি নিউজের এক সাংবাদিক জন এ স্কালির মাধ্যমে। পরে ঠিক হয় যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন মিসাইল সরিয়ে নেবে আর যুক্তরাষ্ট্র কখনোই কিউবা আক্রমন করবে না।
পুরো ঘটনাটি ১৩ দিনের। আর সিনেমাটা সেই ১৩ দিন নিয়েই। ২০০০ সালের এই ছবিটির মূল অভিনেতা কেভিন কষ্টনার।

৭. ফেয়ার গেম:
জোসেফ সি উইলসন বিভিন্ন দেশে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ইরাক আক্রমণ করার ঠিক পরের ঘটনা। জর্জ বুশ ২০০৩ সালে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতা দিয়ে জানালেন যে, ইরাক ম্যাস ডিসট্রাকশন বোমা তৈরি করেছে ইরাক এবং ব্যবহার হচ্ছে ইউরানিয়ামস।
এই বক্তৃতা দেওয়ার পর পরই জোসেফ উইলসন নিউ ইয়র্ক টাইমস এ লেখা পাঠান। সেখানে তিনি বলেন যে, জর্জ বুশের দাবি সত্য নয়। শুরু হয় নতুন সংকট। উইলসনের স্ত্রী ভ্যালরি প্লাম একজন সিআইএ এজেন্ট। এতে শুরু হয় নতুন ধরণের সংকট। হোয়াইট হাইজের সঙ্গে এক অসম যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন তারা।

220px-Fair_Game_Poster.jpg


ভ্যালরি প্লাম সেই ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখেছেন। নাম-ফেয়ার গেম: মাই লাইফ এস এ স্পাই, মাই বিট্রেয়াল বাই দ্য হোয়াইট হাউজ। সেই বই নিয়ে সিনেমা, ফেয়ার গেম।
২০১০ সালের ছবি। শেন পেন আর নোয়ামি ওয়াটস ছবিটার মূল্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলা যায়।

৮. জেএফকে: মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেএফ কেনেডি আততায়ীর হাতে খুন হন ১৯৬৩ সালের ২২ নভেম্বর। এজন্য দায়ী করা হয়েছিল লি হার্ভে অসওয়াল্ডকে। কেন কেনেডিকে খুন করা হয়েছিল সে রহস্য আজও আবিস্কার হয়নি।

220px-JFK_movie_poster.jpg


পরিচালক অলিভার স্টোনের সবচেয়ে আলোচিত ছবি জেএফকে। এখানে দেখানো হয়েছে কেন মারা হলো কেনেডিকে। একজন আইনজীবী জিম গ্যারিসন (কেভিন কষ্টনার) খুঁজে খুঁজে বের করেন এর রহস্য। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে যে কেনেডিকে খুন করা হয়েছিল সেটিই বলা হয়েছে ছবিটিতে। এমনকি এ জন্য পরবর্তী সময়ের মার্কিন প্রেসিডেন্ট জনসনকেও দায়ী করা হয়েছে।
১৯৯১ সালে মুক্তি পাওয়ার আগে থেকেই চরম বিতর্ক শুরু হয়েছিল জেএফকে নিয়ে। অসংখ্য লেখালেখি হয় ছবিটি নিয়ে।

৯. রেডস: জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো ১০দিন পড়েন নাই এমন পড়ুয়া পাওয়া মুশকিল। জন রীড মার্কিন সাংবাদিক। তিনি রুশ বিপ্লব ঘটার সেই ১০ দিনের বর্ণনা দিয়েছিলেন এই বইটিতে। ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর বলশেভিকদের নেতৃত্বে রাশিয়ার শ্রমিক শ্রেনী ক্ষমতা দখল করেছিল। এর আগে জারের পতনের পর মেনশেভিকরা ক্ষমতায় ছিল।

220px-Redsposter.jpg


জন রীড সেই সময়ের বিপ্লবের মহাকাব্যিক বর্ণনা দিয়েছিলেন বইটিতে।
সেই বই নিয়েই ছবি রেডস। ১৯৮১ সালে মুক্তিপাওয়া ওয়ারেন বেটির এই ছবি এরই মধ্যে ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে।

১০. ক্রাই ফ্রিডম: ১৯৭০ সাল। দনি আফ্রিকা কখন বর্ণবাদি সাদাদের দখলে। সংগ্রাম করছে কালোরা। সাংবাদিক ডোনাল্ড উডস (কেভিন ক্লেইন) তখন দক্ষিণ আফ্রিকায়। বন্ধুত্ব হয় কালোদের আন্দোলনের নেতা স্টেভ বিকোর (ডেনজেল ওয়াশিংটন) সাথে। পুলিশের হাতে মারা যায় স্টিভ বিকো। এ নিয়ে অনুসন্ধান ও লিখতে গিয়ে ঝামেলায় পরে উডস। ফলে এক পর্যায়ে বাঁচতে পালিয়ে যেতে হয় দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে। সেই পালিয়ে যাওয়া নিয়ে ছবি।

Cry_Freedom.jpg


গান্ধি ছবির পরিচালক স্যার রিচার্ড এটেনবরোর এই ছবিটি ১৯৮৭ সালের।

Rate this:

Loading

রেটিং

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *